বিয়ে : ফ্যান্টাসি নয়, জিম্মাদারি


বিয়ে মানে দায়িত্ব। বিয়ের সাথে জিম্মাদারি এক সুতোয় গাঁথা। একটা জীবনের পুরো দায়িত্ব আপনাকে কাঁধে তুলে নিতে হবে। স্ত্রীর দেখভাল, ভরণপোষণ, আবাসন, পর্দার সুযোগ আপনাকেই করে দিতে হবে। পুরুষ হিসেবে আপনি তার কর্তা। তার মাধ্যমে যত সন্তান দুনিয়াতে আসবে, তাদের অভিভাবকও আপনি নিজেই। বাচ্চারা আপনার ছাতার নিচেই তরতর করে বেড়ে উঠবে। বিবি সাহেবা আপনাকে কেন্দ্র করেই সুখের বাগান রচনা করবে। আপনি হবেন পরিবার নামক দুর্গের পাহারাদার। নবি কারীম ﷺ বলেছেন:


“পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

বুখারি, ৭১৩৮; তিরমিযি, ১৭১১; আবু দাউদ, ২৬০০

তিনি আরও বলেন,


“অবশ্যই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে তার দায়িত্বাধীন ব্যক্তি ও বিষয় সম্পর্কে (কিয়ামতের দিন) প্রশ্ন করবেন—সে কি তার (অধীনস্থ জিনিসের) যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ করেছে, নাকি তার প্রতি অবহেলা করেছে। এমনকি গৃহকর্তার নিকট থেকে তার পরিবারের লোকদের বিষয়েও কৈফিয়ত নেবেন।”

[সহিহ ইবনু হিব্বান, ৪৪৭৫; সহিহ আল জামি, ১৭৭৪]


পুরো দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের ভার আপনার ওপর। এখানকার স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখা আপনারই কর্তব্য। পুরুষত্বের বাহুডোরে আপনি আঁকড়ে রাখবেন নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে। তাদের ওপর কোনো আঘাত আসলে প্রথমে এগিয়ে যেতে হবে আপনাকেই। প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করবেন। তবুও পরিবারের ওপর আঘাত আসতে দেবেন না। আপনি থাকবেন সদা অতন্দ্র প্রহরীর মতো। আপনারই তো নির্ঘুম রাত পার হবে পরিবারের সুরক্ষায়। অন্যেরা হাঁপিয়ে উঠবে, কিন্তু দায়িত্বের চাপ আপনাকে সারাক্ষণ রাখবে যুবকের মতন চাঙা। কবি মিরাজ ফয়যাবাদীর ভাষায়:


مجھ کو تھکنے نہیں دیتا یہ ضرورت کا پہاڑ
میرے بچے مجھے بوڑھا نہیں ہونے دیتے
ক্লান্ত হতে দেয় না আমায় জরুরতের পাহাড়,
বুড়ো হতে দেয় না আমায় বাচ্চাদের আবদার।


সাতপাঁচ না-ভেবে হুটহাট যদি বিয়ে করে ফেলেন, তবে হয়তো বেশিদিন সার্ভাইব করতে পারবেন না। আবেগের মোহ কেটে বাস্তবতা যখন সামনে এসে দাঁড়াবে, সেইদিন নিজেকে মনে হবে পরাজিত সৈনিকের মতন। যে কিনা শত্রুর প্রবল আক্রমণ দেখে এখন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাচ্ছে।


পুরুষ যদি মুদ্রার এপিঠ হয়, তবে ওপিঠে লেখা থাকবে দায়িত্ব। এই কথাটা আমি অনেক ভেবেচিন্তে বলছি। রেসপন্সিবিলিটি মানেই পুরুষ। দিনশেষে সেক্রিফাইস করতে হবে পুরুষকেই। ছাড় দিতে হবে পরিবারের কর্তাকেই। নারী তার ঘর সামলাবে, বাচ্চা সামলাবে, রান্নাবাড়া করবে… কিন্তু রোজগারের দিকটা ভাবতে হবে পুরুষকেই। মাস শেষে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো সপ্তাহ কিভাবে চলবে, সেই টেনশন নারী করে দেবে না। বাচ্চার দুধ, মায়ের ওষুধের টাকা, স্ত্রীর মৌলিক প্রয়োজন, বাবার আবদার—এগুলো সরবরাহ করতে হবে দায়িত্বশীল পুরুষকেই। নারী চিন্তা করবে বেগুনে পোকা আছে কি না। কিন্তু এই বেগুন ঘর অবধি কিভাবে আসবে, সেই চিন্তা তার নয়। অনেক সময় অধীনস্থদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজের ছেঁড়া জুতোর দিকে তাকানোর ফুরসত হবে না আপনার, এটার নামই পুরুষ। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,


“একটি মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তাদের অধিকার নষ্ট করবে—যাদের ভরণপোষণের ব্যাপারে সে দায়িত্বশীল।”

[মুসনাদে আহমাদ, ৬৪৫৯, ৬৭৮০; আবু দাউদ, ১৬৯২; বুলুগুল মারাম, ১১৪৩]


এখন কিছু বই বেরিয়েছে, যেগুলো পড়লে মনে হবে বিয়ে মানে শুধু মজমাস্তি। খালি সুকুন আর সুকুন। স্ত্রীর সাথে খুনশুটি, রাতের বেলায় দৌড়াদৌড়ি, খোশগল্প, প্রেম-ভালোবাসা… আহা কী সুখের জীবন!
হ্যাঁ, এগুলো আছে। তবে এগুলো সংসার জীবনের একটা অংশ মাত্র। পূর্ণাঙ্গ চিত্র না। এগুলোকে বলা যায় ট্রেইলার, পিকচার এখনো বাকি। কবি ইকবাল বলেছিলেন,


ستاروں سے آگے جہاں اور بھی ہیں
ابھی عشق کے امتحاں اور بھی ہیں
তারকারাজির পরে আরও অনেক জগৎ আছে,
ভালোবাসার পরীক্ষা এখনো অনেক বাকি আছে।


অতীতের যুগে একটা পুরুষকে যত কষ্ট আর বাস্তবতার মোকাবিলা করতে হতো, তার সিকিভাগও এই জামানার পুরুষরা ফেইস করে না। কিন্তু তারপরেও আজ তারা হতাশ। আসলে যারা ভোগবাদী মানসিকতা নিয়ে বিয়ে করে, সাংসারিক জীবনটা তাদের জন্যে কখনোই উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। এরাই পরবর্তীতে গিয়ে ডিপ্রেশনে ভোগে। কাউন্সেলিং করানোর জন্যে বিভিন্ন সাইকোলজিস্টদের শরণাপন্ন হয়। পুরুষ মানুষ যত বেশি দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়াবে, তাকে ডিপ্রেশন তত বেশি চেপে ধরবে। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে বৈরাগী সাজার মধ্যে পুরুষোচিত কোনো আনন্দ নেই। আছে কাপুরুষতা।


Dr. John Gray এবং Deborah Tannen দেখিয়েছেন যে, পুরুষ তার পুলকতা অনুভব করে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই। এটাই তার স্বস্তির জায়গা। লেখকগণ কয়েকটি পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন:
– পুরুষের চিন্তা-চেতনা, কথাবার্তা সাধারণত যৌক্তিক, আবেগ-বর্জিত হয়ে থাকে। তারা আবেগের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাস্তবতার দিকে।

  • অধীনস্থদের প্রয়োজনের সময় তারা মোটিভেটেড এবং শক্তিতে বলীয়ান হয়। দায়িত্বের হক আদায় করতে তখন কাজে নেমে পড়ে।
  • কতটুকু দিতে পারলাম, এই ব্যাপারে তারা উদ্‌বিগ্ন থাকে। কতটুকু নিতে পারলাম, এই হিসাব তারা করে না।
  • যখন তার অধীনস্থ নারী সুখী থাকে, তখন সে নিজেকে মনে করে সফল পুরুষ। আর অধীনস্থ নারীকে অসুখী দেখলে, সে ব্যর্থ মনে করতে থাকে নিজেকে।
  • এগুলো হলো সুস্থ ফিতরাতসম্পন্ন পুরুষের বৈশিষ্ট্য। আর পুরুষত্বের আসল স্বাদ লুকিয়ে রয়েছে দায়িত্বের হক আদায়ের মধ্যেই।
  • [John Gray, Ph.D, Men Are from Mars, Women Are from Venus, (UK: HarperCollins, 1992); Deborah Tannen, You Just Don’t Understand: Women and Men in Conversation (William Morrow Paperbacks; 1st edition, February 6, 2007)]


নারীর জন্যেও বিয়েটা দায়িত্বের বিশাল এক ক্ষেত্র। তার ওপরেও রয়েছে আল্লাহর দেওয়া নির্ধারিত কর্তব্য। পুরুষ বাইরে থেকে ইনকাম করে টাকা এনে দেবে। কিন্তু ঘরে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে একজন দায়িত্বশীল স্ত্রীকেই। নারীকে বলা যায় ঘরের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। পরিবারের সদস্যদের পুষ্টিগুণ, সঠিক পরিচর্যা, সন্তান প্রতিপালন, স্বামীর খেদমত ইত্যাদি ঘরোয়া বিষয়ে সে দায়িত্বশীল। এ ব্যাপারে তাকেও জবাবদিহি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,


“নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল। সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

[বুখারি, ৭১৩৮; তিরমিযি, ১৭১১; আবু দাউদ, ২৬০০]


এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেন, ‘স্ত্রী স্বামীর ঘরের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার মানে হলো—স্বামীর ঘরের সুন্দর ও পূর্ণ ব্যবস্থাপনা, স্বামীর কল্যাণ কামনা, তাকে ভালো কাজের উপদেশ দেওয়া, স্বামীর ধনসম্পদ ও তার নিজের ব্যাপারে পূর্ণ আমানতদারিতা বজায় রাখা।’


ফ্যান্টাসি ঝেড়ে নারীকেও প্রস্তুতি নিতে হবে জীবনযুদ্ধের জন্যে। কেননা, বিয়ে মানেই সকল কিছুর সমাধান না। সমাধানের রাস্তা মাত্র। বিবাহিত জীবনে বহু অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত সামনে এসে দাঁড়াবে। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলা করতে হবে। একটা পরীক্ষা শেষ না-হতেই অপেক্ষা করবে আরও বড় কোনো পরীক্ষা। কখনো কালবোশেখি ঝড়, কখনো গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রতাপ, কখনো কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া তাকে তাড়া করবে। এসব দেখে মনোবল হারালে চলবে না। বরং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে তার যথাযথ সুরাহা করতে হবে।


বিয়ে তো সবেমাত্র ভর্তি পরীক্ষা। সামনে মিড টার্ম, সেমিস্টার, ভাইভা, থিসিস… কত ধাপ পড়ে আছে। পাড়ি দিতে হবে অনেকগুলো বর্ষ। অনেকটা কঠিন পথ। সে জন্যে চাই মানসিক প্রস্তুতি। একটা স্বপ্ন দেখে যদি এই পথে কেউ আসে, তবে আরেকটা স্বপ্ন দেখে হয়তো চলে যাবে। বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না।