ভ্যালেন্টাইন্স ডে


কে কবে এই দিবস চালু করেছিল, তা কেউ জানে না। খোদ পশ্চিমা-বিশ্বও এটা নিয়ে পেরেশান। কোত্থেকে এলো এই জঞ্জাল? কে বানাল সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে এত রোম্যান্টিক গল্প? গবেষকরাও খুঁজে পাচ্ছে না সদুত্তর। The New York Times পত্রিকায় ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে একটি আর্টিক্যাল প্রকাশিত হয়।[1] সেখান থেকে কিছু কথা আপনাদের সামনে শেয়ার করছি।

ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জ্যাক বি. অরুচ এই দিবসটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। ১৯৮১ সালে ‘St. Valentine, Chaucer and Spring in February’ আর্টিক্যালে তিনি বলেন—১৪ শতকের কবি Geoffrey Chaucer সর্বপ্রথম সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে লেখালেখি করেন। তার আগে ইউরোপের কেউই এই ধারণার সাথে পরিচিত ছিল না। এই যাজককে কেন্দ্র করে প্রচলিত রোমান্টিক গালগল্পের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সাথে ১৪-ই ফেব্রুয়ারির কোনো সম্পর্কও নেই।

তাহলে এই গল্প কেন বানানো হলো?

সেটার উত্তরও দিয়েছেন প্রফেসর অরুচ। ইউরোপীয়দের মনে হয়েছিল ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামটি বেশ ভালো শোনায়। একটা ধর্মীয় ফ্লেবার আছে এর মধ্যে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে অন্যান্য যেসব ‘সেন্ট ডে’ পালন করা হতো, সেগুলো ততটা রোম্যান্টিক না। যেমন: সেন্ট স্কলাসটিকা, সেন্ট অস্ট্রাবার্থা, সেন্ট ইউলেলিয়া ইত্যাদি। তাই নিজেদের অশ্লীল কার্যকলাপকে ধর্মীয় মোড়কে নর্মালাইজড করার জন্যে দিবসটি চালু করা হয়। এর পেছনে যুক্ত করা হয় প্রণয়ের নানান উপাখ্যান। কিন্তু এগুলো শতভাগ বানোয়াট কাহিনি দিয়ে ভরপুর। অনেকটা আমাদের দেশে প্রচলিত ইউসুফ-জুলেফার মিথ্যা কাহিনির মতো। প্রেমকে ধর্মীয় রূপে বৈধতা দেওয়ার জন্যেই মূলত এইসব গল্পের অবতারণা করা হয়। ঠিক একই কাজ করেছে ইউরোপীয়রা। ২০১১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর অরুচ আফসোস করে বলেছিলেন,

‘(আমার গবেষণা) কোনো পার্থক্যই তৈরি করেনি। প্রতি বছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে-কে নিয়ে যেসব লেখা প্রকাশিত হয়, তাতে একই মিথ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।’

দলিল থাক বা না-থাক, তাতে কী আসে যায়! নষ্টামি করার সুযোগ তো পাওয়া যাচ্ছে! এটাই-বা কম কিসে! গবেষকদের কথা শুনলে তো আর মজ-মাস্তি করা যাবে না! তাই নাপাক প্রেমকে সেলিব্রেট করতে মিথ্যা-জড়ানো এই দিনটিকেই পালন করে থাকে কাপলরা।

বাংলাদেশে কোত্থেকে এলো এই আবর্জনা?

সাংবাদিক শফিক রেহমান দিবসটি বাংলা মুলুকে আমদানি করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই ভদ্রলোক ছিলেন লন্ডনে। দেশে ফিরে ১৯৯৩ সালে এই যিনা দিবসটি তিনি পালন শুরু করেন। বিলাতে দিবসটি ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নামে প্রচলিত থাকলেও আমাদের দেশে তা প্রচার করা হয় শুধু ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নামে। পরবর্তী সময়ে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘ভালোবাসা দিবস’। অথচ সবাই জানে—এটি মোটেও ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর সঠিক তর্জমা নয়। ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যিনার কালচারকে সহজলভ্য করতেই এই ছলছাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়। শফিক রেহমান বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজে বলেছেন:

‘আমি বহু বছর লন্ডনে থাকার সুবাদে জানতাম, এখানে কিভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদ্‌যাপিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আমি এই নামের পরিবর্তে ভালোবাসা দিবস দিয়েছিলাম ইচ্ছে করে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে বললে অনেকে বলবে এটা খ্রিষ্টানদের ব্যাপার, বলবে আমি এটা ধর্মীয় দিকে টেনে নিয়ে গেলাম।’[2]

যে-দিবসটির কোনো অস্তিত্ব পশ্চিমা গবেষকরাও খুঁজে পাননি, সেটাকেই ঘটা করে পালন করছে বাংগু পোগোতিশীলরা! বাহ, বহুত খুব! যিনার কালচারকে সহজলভ্য করার জন্যে এখন ‘ভ্যালেন্টাইন ফিলোসফি’ দাঁড় করানো হচ্ছে। সামাজিকভাবে পালন করা হচ্ছে এই দিবসটি। এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পহেলা ফাল্গুনকেও। একটা বাংলিশ ফ্লেবার দেওয়ার জন্যেই মূলত এই চক্রান্ত। বছরের এই দিনটিতে অনেক প্রেমিকা নিজে সঁপে দিচ্ছে প্রেমিকের বেদীতে। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে রিকশার হুট উঠিয়ে শুরু করছে যিনার কার্যক্রম। হোটেল বুকিং দিয়ে রাত-কাটানোর খবর তো আছেই! আর বছর ঘুরলেই রাস্তায় রাস্তায় পাওয়া যাচ্ছে নবজাতক শিশু! শয়তান বেশ ভালোই মেহনত করেছে। শফিক রেহমান তাই অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘এতটা যে হবে, ভাবিনি।’[3]


[1] The Origins of Valentine’s Day: Was it a Roman Party or to Celebrate an Execution?, The New York Times, Feb. 14, 2023

[2] কখনো ভাবিনি যে এই ভালোবাসা দিবস এত বড় রূপ নেবে, বিবিসি, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০।

[3] প্রাগুক্ত।