প্রণয় যখন পূজার বেদী


অনবরত যিনা করতে থাকলে অন্তর হয়ে পড়ে কলুষিত। সেই অন্তর দিয়ে মন্দকে আর মন্দ বলে উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। ফলে লজ্জার কাজটাও নির্লজ্জের মতো করে ফেলে মানুষ। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই গোনাহ তাকে নিয়ে যায় শিরকের জগতে। কিছু যুবক-যুবতী তাদের সঙ্গীর সাথে এমন চরম ভালোবাসায় জড়িয়ে যায়, যে-ভালোবাসার একান্ত হকদার ছিলেন আল্লাহ তাআলা। এভাবে তাওহীদের চেতনা বিলীন হয়ে যায় তাদের মধ্য থেকে। আল্লাহর ইবাদতে রত হওয়ার চাইতেও ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে রাত কাটানোটা তাদের কাছে বেশি মধুর মনে হয়। আল্লাহর দরবারে সিজদা দেওয়ার চেয়েও মেয়ে বান্ধবীর ঊরুতে মাথা রাখাটা তাদের কাছে বেশি প্রশান্তিকর লাগতে থাকে। আল্লাহর সাথে মুনাজাত করার চাইতেও গোপনে যিনার অভিসারে মেতে উঠতে পারলে তারা বেশি খুশি হয়। কুরআন তিলাওয়াতের চেয়েও তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় প্রেমাস্পদের মেসেজ চেক করা। কতটুকুই ইবাদত করতে পারলাম—এর বদলে তারা চিন্তা করে প্রেমসখাকে কতটুকু ভালোবাসতে পারলাম। একপর্যায়ে তারা আর আল্লাহর জন্যে বাঁচতে চায় না। বাঁচতে চায় ভালোবাসার মানুষটির জন্যে—‘আমি তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী দাও গলেতে মালা…’


এই-যে চরম লেভেলের ভালোবাসা, এটা কী প্রমাণ করে?


“আর মানুষের মধ্যে এমনো লোক আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, আল্লাহকে ভালোবাসার মতো তাদেরকে ভালোবাসে।”[1]


একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, যারা এ-রকম হারাম রিলেশনে জড়িত, তারা একে অপরকে কী মাত্রায় ভালোবাসে! একেবারে সুপার-গ্লুর মতো লেগে থাকে সারাক্ষণ। ভালোবাসার মানুষের জন্যে সারা দুনিয়া কুরবান করতে প্রস্তুত থাকে। অথচ দুনিয়ার সবকিছুর চাইতেও কেউ যদি আল্লাহকে বেশি ভালোবাসতে না পারে, তবে তার ঈমান পূর্ণ হবে না। কিন্তু ওই প্রেমিক-প্রেমিকা একে অন্যকে আল্লাহর চেয়েও বেশি ভালোবাসতে থাকে। আল্লাহর বিধানের চেয়েও প্রেমের কমিটম্যান্ট রক্ষা করা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। ভয়ানক গোনাহকেও জীবনের চরম উপভোগ্য বিষয় মনে হয়। গোনাহকে সেলিব্রেট করতেও তাদের ঈমান কাঁপে না। বরং এটাকে তারা প্রেমের অধিকার ভাবতে থাকে। একটা সময় তারা ভালোবাসার ক্ষেত্রে চলে যায় শিরকি অবস্থানে। একটা গান তো হরহামেশাই বাজে:


তুয মে রাব দেখতা হে, ইয়ারা মে কিয়া কারু,
সাজদে সার ঝুকতা হে, ইয়ারা মে কিয়া কারু![2]


এই ধরনের শিরকি গান অহরহ গাইছে মানুষ। বুঝেশুনে, মনেপ্রাণে, দিল থেকে। এটা কী প্রমাণ করে?


প্রেমের মাধ্যমে শয়তান আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে শিরকের অবস্থানে। আমরা মনে করি শুধুমাত্র ইবাদতের ক্ষেত্রেই বুঝি শিরক হয়। না ভাই, এর বাইরেও শিরক আছে। আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করলে যেমন শিরক হয়, তেমনি কাউকে আল্লাহর চেয়ে বেশি মহব্বত করলেও শিরক হয়। এটাকে বলে ভালোবাসার শিরক।[3] এটাও মারাত্মক অপরাধ। শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, ‘এটি এমন শিরক, যা আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না।’[4]

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলেন, ‘প্রেমে পড়ে মানুষ প্রেমিকাকে আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলে। তাদের অন্তরে আল্লাহর চেয়ে প্রেমিকার প্রতিই বেশি ভালোবাসা থাকে। এই ধরনের প্রেমকে কখনো ক্ষমা করা হয় না। কারণ, এটা হচ্ছে জঘন্য শিরকের মধ্যে একটি। আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শিরক করার গোনাহ ক্ষমা করেন না।’[5]_[6]

শিরক করলে বান্দার স্থান হবে জাহান্নাম।


“নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন, আর তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। এরূপ জালিমদের জন্যে কোনো সাহায্যকারী নেই।”[7]


হারাম ভালোবাসাগুলো কেন শিরকের দিকে চলে যায়?
এই ভালোবাসার শুরুই হয়েছে শয়তানের হাত ধরে। আর শয়তানের পরম আকাঙ্ক্ষা হলো মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যাওয়া। শয়তান এটাই চাইবে, একজন বান্দা সর্বোচ্চ লেভেলের গোনাহটা করুক। আর আমরা সবাই জানি, সবচেয়ে মারাত্মক গোনাহ হচ্ছে শিরক।[8] শয়তান যখন বান্দাকে ডিরেক্ট শিরকে লিপ্ত করতে ব্যর্থ হয়, তখন সে বিকল্প হিসেবে দেখিয়ে দেয় হারাম ভালোবাসার পথ। এরপরের কাজটুকু তার জন্যে সহজ হয়ে যায়।


বারসিসাকে যে রাস্তা ধরে শয়তান জাহান্নামী বানিয়েছিল, ঠিক একই পথ ধরে সে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের যুব-সমাজকে। এর মাধ্যমে বান্দা অনুপ্রবেশ করছে শিরকের ভয়ানক জগতে। ভালোবাসার শিরকের প্রভাবে প্রেমিক উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। হতাশার সাগরে নিমিজ্জিত হচ্ছে রিলেশন না টিকলে। সে ভুলে যাচ্ছে নিজের আত্মপরিচয়, ভুলে যাচ্ছে তার বাবা-মা-সমাজ-সংসারকে। সর্বোপরি সে ভুলে যাচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে। একপ্রকার মানসিক বিকারগ্রস্ততা ভর করছে তার মধ্যে। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা বলেন, “প্রেমে পড়ার কারণে মানুষ তার বুদ্ধি এবং বিবেক হারায়, আদব এবং দ্বীন হারায়। সারাক্ষণ এটা নিয়ে পড়ে থাকার কারণে দ্বীন ও দুনিয়ার উন্নতিতে সে বাধাপ্রাপ্ত হয়।”[9]


প্রেমিকার কাছে প্রেমিকরা বাঁদরের মতো বান্ধা থাকে। সে তার ইচ্ছামতো ছেলেটাকে নাচায়। মেয়েটা চাইলে সে হাসে, আর কাঁদালে সে কাঁদে। অন্তরের দিক থেকে সে হয়ে যায় এক মানব-সুন্দরীর দাস। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য নির্ধারিত ভালোবাসাটা সে নিবেদন করে প্রেমিকার সমুখে। এভাবেই চলে শয়তানের গোলামি। প্রিয়তমাকে বলতে থাকে—‘মন পাঁজরে শুধু তুমি আছো, কেউ তো আর থাকে না।’ ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা খুব সুন্দর করে বলেছেন, ‘যখন কারও অন্তর কোনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়… তখন সে নারীর খাঁচায় বন্দি হয়ে যায়। সেই নারী তার মধ্যে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করে। যেভাবে খুশি সেভাবে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে থাকে।… সেই নারী তার ওপর এমনভাবে শাসন চালাতে থাকে, যেমনিভাবে প্রতাপশালী বাদশাহ তার প্রজাদের ওপর শাসন চালায়… তবে নারীর শাসন রাজার শাসনের চেয়েও ভয়ানক। কারণ, অন্তরের বন্দিদশা দৈহিক বন্দিদশার থেকেও গুরুতর।’[10]


এটা একজন বান্দার জন্য কতটা ভয়াবহ বিষয় যে, একটা মেয়েকে কেন্দ্র করে তার প্রাত্যহিক কাজগুলো আবর্তিত হচ্ছে। সারাক্ষণ সে একটা মেয়েকে নিয়ে ফিকির করছে… যোগাযোগ করতে না পারলে পাগল হয়ে যাচ্ছে…। অথচ আল্লাহর ব্যাপারে, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিপরীত দিকে হারাম রিলেশনে থাকা মেয়েটিও সর্বক্ষণ তার প্রেমিককে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে তার বয়ফ্রেন্ডের সন্তুষ্টিই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিন্তায়-চেতনায়-শয়নে-স্বপনে সে কেবল তাকেই অনুভব কর‍তে থাকে। যেভাবে মুমিনরা নিজেদের জিহ্বাকে আল্লাহর স্মরণে আর্দ্র রাখে, সেভাবে ওই মেয়েটাও প্রেমিককের নাম জপতে থাকে। প্রেমিক হয়ে যায় তার প্রণয়-দেবতা। সারাক্ষণ তারই আরাধনা চলতে থাকে হৃদয়মন্দিরে।


হায় আফসোস! মুসলমানের সন্তানরা তাদের মুহূর্গুলো পার করছে যিনার সাগরে ডুব দিয়ে! তাদের প্রতিটা ক্ষণ কাটছে হারাম রিলেশনের ফিকির নিয়ে। অশ্লীল গল্প আর যৌনতা নিয়ে। আল্লাহকে নিয়ে তাদের কোনো ফিকির নেই। দ্বীনের বিজয় নিয়ে তাদের কোনো আক্ষেপ নেই। রাসূলের সম্মান রক্ষায় তাদের পদক্ষেপ নেই। ইসলামের বিধান মানার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। মহান প্রভুকে উপাস্যের জায়গা থেকে ডিলেট করে সেখানে ভালোবাসার মানুষটিকে তারা বসিয়ে দিয়েছে। এখন দিনরাত চলছে প্রেমাষ্পদের পূজা।


প্রিয় ভাই ও বোন! যারা এই ধরনের চরম পাপে লিপ্ত আছেন, তারা সাবধান হোন। এটা কোনো সাধারণ গোনাহ না। ঈমান-বিনষ্টকারী ভয়ংকর গোনাহ। মনে রাখবেন—শুধুমাত্র দুর্গা, সরস্বতী, কালী কিংবা লক্ষ্মীর সামনে মাথানত করাটাই পূজার একমাত্র ভার্সন না। পূজা মানুষেরও হতে পারে। যেমনটা আজকালকার প্রেমিক-প্রেমিকারা করে থাকে। কিন্তু এটাকে তারা অপরাধ মানতে নারাজ। বরং তাদের দাবি হচ্ছে, এটাই নাকি ভালোবাসার অধিকার। ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে এখন প্রেমধর্মের উপাসনা করছে তারা!


[1] সূরা বাকারা, ২ : ১৬৫।

[2] অর্থ : তোমাতেই রব দেখতে পাই, প্রিয়া আমি করব কী, সিজদায় মাথা নুইয়ে যায়, প্রিয়া আমি করব কী!।

[3] মুহাম্মাদ ইবনু আবদিল ওয়াহহাব, কিতাবুত তাওহীদ, পৃ. ১২১-১২৩।

[4] শিরকের স্বরূপ ও এর প্রকারগুলো কি কি?, 26 নভেম্বর 2023, ইসলাম-কিউএ।

[5] ইবনুল কাইয়্যিম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ১৫০।

[6] আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।” [সূরা নিসা, ৪ : ৪৮]

[7] সূরা মায়িদা, ৫ : ৭২।

[8] “নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।” [সূরা লুকমান, ৩১ : ১৩]

[9] ইবনু তাইমিয়্যা, আল-ইস্তিকামাহ, ১/৪৫৯।

[10] ইবনু তাইমিয়্যা, আল উবুদিয়্যাহ, পৃষ্ঠা : ৮৯।