প্রেম নিয়ে হাজারও গল্প-কবিতা-উপন্যাস-গান রচিত হয়েছে। বেশিরভাগ রচনাতেই খুব গ্লোরিফাই করা হয়েছে শব্দটাকে। প্রেমকে বানানো হয়েছে স্বর্গীয় বিষয়। ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়’ কিংবা ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’—এই টাইপের কলি শুনে আমরা অভ্যস্ত। নারী-পুরুষের বিবাহ-বর্জিত প্রেমটা এখন খুব মধুর বিষয়। অনেকেই এর নাম দিয়েছে ‘পবিত্র ভালোবাসা’, ‘স্বর্গীয় অনুভূতি’, ‘মধুর মিলন’… শয়তানি আর কাকে কয়!
ছেলে-মেয়ের অবৈধ ভালোবাসা বোঝাতে ‘প্রেম’ শব্দটা অহরহ ব্যবহৃত হয়। অথচ এটা ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছুই না। এটার নাম প্রেম নয়। এটাকে ভালোবাসাও কয় না। এর আসল নাম হলো ‘যিনা’। হারাম রিলেশনশিপ বা প্রেমের আসল নাম হলো ‘যিনা-ব্যভিচার’। শয়তানের প্ররোচনায় আমরা মনে করে থাকি—শুধু ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়ালেই বুঝি যিনা হয়। না, ভুল ধারণা। লজ্জাস্থানের ব্যবহার হলো যিনার সর্বোচ্চ পর্যায়। এর বাইরেও যিনার প্রকার রয়েছে। চোখ, কান, মুখ, হৃদয়—প্রতিটি অঙ্গের জন্যে রয়েছে আলাদা আলাদা বিধান। নবি কারীম ﷺ বলেন,
“দু-চোখের ব্যভিচার হলো (হারাম দিকে) তাকানো, দু-কানের ব্যভিচার হলো (অশ্লীল জিনিস) শোনা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (অশ্লীল) কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হলো শক্ত করে ধরা, পায়ের ব্যভিচার হলো হেঁটে যাওয়া, হৃদয়ের ব্যভিচার হচ্ছে কামনা-বাসনা। আর লজ্জাস্থান তা সত্যায়িত বা মিথ্যা সাব্যস্ত করে।”[1]
গাইরে মাহরামের[2] দিকে তাকানো হলো চোখের যিনা। তাদের সাথে খোশগল্প করা হলো মুখের যিনা। তাদের স্পর্শ করা হলো হাতের যিনা। তাদের নিয়ে কল্পনায় স্বপ্ন বোনা অন্তরের যিনা। লজ্জাস্থান কেবল সঙ্গমের কাজটি করে থাকে। এর আগে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় শরীরের বাদবাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সেই জন্যে ওইসব অঙ্গের জন্যেও রয়েছে আলাদা আলাদা যিনার বিধান। আজকাল এইসব যিনার পাপকে মানুষ পাপই মনে করে না। তাদের কাছে ব্যভিচারের সংজ্ঞা হলো সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক। এছাড়া আর কোনো কিছুকে তারা যিনা বলতে নারাজ। তাই তো যাস্ট-ফ্রেন্ড নাম দিয়ে ছেলেপেলেরা দেদারছে মাখামাখি করে বিপরীত লিঙ্গের সাথে। নারী-পুরুষ মিলে একসাথে ট্যুরে যায় দূর-দূরান্তে। রিসোর্টে একসাথে রাত কাটায় বন্ধু-বান্ধবীরা। দলবেঁধে ক্যাম্পাসে আড্ডায় মেতে ওঠে সহপাঠিরা। এগুলোর সবই যিনা। এখানে ‘পবিত্র দায়িত্ব’ বা ‘পবিত্র আমানত’ বলে কিছুই নেই। বিয়ে-বহির্ভূত প্রেম-ভালোবাসার সবটাই ‘অপবিত্রতা’ দিয়ে ছাওয়া।
“তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেছেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেছেন।”[3]
আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তার প্রতিটি জিনিসই অপবিত্র। এগুলোকে গ্লোরিফাই করা কোনো মুমিনের কাজ নয়।
ধারেকাছেও যেয়ো না
আমাদের কোনো শুভানুধ্যায়ী যদি বলেন, ‘সাবধান! তুমি ওই এলাকার কাছেও যাবে না’—এর দ্বারা কী বোঝা যায়? বুঝতে হবে, ওখানে ভয়াবহ কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে, যার দরুন তিনি আমাকে সতর্ক করছেন। আমাদের সবচেয়ে বড় শুভানুধ্যায়ী হলেন আল্লাহ তাআলা। প্রতিটি বান্দার ব্যাপারে তিনি কল্যাণকামী। আর সেই মেহেরবান রব আমাদের সতর্ক করে বলেছেন:
“আর তোমরা যিনার ধারেকাছেও যেয়ো না। ওটা অশ্লীল কাজ এবং অতি জঘন্য পথ।”[4]
যিনা মানেই অশ্লীলতা। আর সকল অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ।[5] আমাদের পালনকর্তা চান, তাঁর বান্দারা শয়তানের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকুক। আর শয়তান আক্রমণ করে অশ্লীলতার দরজা দিয়ে। এ-কারণে তিনি বলছেন যে, তোমরা যিনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও যাবে না। যিনা করা তো দূরের কথা, কাছেও যাওয়া যাবে না। কারণ, ধারেকাছে ঘেঁষলেই তোমরা ফিতনায় আক্রান্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু আল্লাহর সেই সতর্কবাণী আমরা কানে তুলিনি।
নিজেদেরকে মর্ডান প্রমাণ করার জন্যে যিনাকে আমরা এতটাই সহজলভ্য করেছি যে—এখন এটাকে গোনাহই মনে হয় না। এটা হয়ে গেছে যুবসমাজের স্বাভাবিক কালচার। তরুণ-তরুণীদের স্বাভাবিক ট্রেন্ড। কে কয়টা প্রেম করবে, সেটার টার্গেট নিয়েই মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়!!! সমাজও এগুলো দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোনো বেহায়া যুগল রিকশার হুট তুলে চলাচল করলে, বাসে খুব ক্লোজলি বসলে, হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটলে, কিংবা অন্তরঙ্গভাবে কোথাও আলাপ করলে—আমাদের ক্ষোভের সঞ্চার হয় না। আমরা যেন বিষয়টাকে সহজ দৃশ্য হিসেবে মেনে নিয়েছি। পার্কে যাব আর সেখানে অবৈধ কাপল থাকবে না, এটা তো হয় না! ছেলেমেয়ে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিবে, এটাই তো স্বাভাবিক!! অনেক বাবা এখন তার মেয়েকে বয়ফ্রেন্ডের হাতে সঁপে দিয়ে আসে দেখাশোনা করার জন্যে!!! এ যেন শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো ঘটনা!
যিনার মতো এত নিকৃষ্ট একটা অপরাধ আমাদের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কলেজ-ভার্সিটিতে খোলামেলাভাবে চলছে যিনার আড্ডা। ছেলে-বন্ধুরা প্রকাশ্য মজলিসে তারই কোনো মেয়ে-বন্ধুর ফিগার নিয়ে বর্ণনা দিচ্ছে। কে কয়টা মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছে, সেটা বলে যাচ্ছে খোলাখুলিভাবে। অনেক মেয়েও আবার কয়েকগুণ এডভান্স। তারা আপডেট পর্ন শেয়ার করছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে। পর্ন অভিনেতাদের নাম শেখাচ্ছে তার ক্লাসমেটকে। সেদিন শুনলাম অভিজাত পাড়ার মেয়েরা নাকি প্রকাশ্যে বলে—আমি এতটা ছেলেকে খাইছি! (আমি খুব দুঃখিত শব্দটার জন্যে। কিন্তু আজকাল এটাই ব্যবহৃত হচ্ছে)। প্রেমিক-প্রেমিকারা একটা প্রবাদও বানিয়ে নিয়েছে—‘মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান!’ শয়তানি আর কারে কয়!
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বলেছিলেন, যিনার ধারেকাছেও না ঘেঁষতে। আজ যিনা করাটাই হয়ে যাচ্ছে গর্বের বিষয়! কে কতটাকে খাইতে পারছে—সেটার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইতস্ততও বোধ হচ্ছে না! এটা যেন শামসুর রাহমানের কবিতার মতো—‘কী কী সহজে হয়ে গেল বলা, কাঁপলো না গলা এতটুকু, বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস…।’
[1] মুসলিম, ২৬৫৭।
[2] যাদের সাথে বিয়ে হালাল।
[3] সূরা আরাফ, ৫ : ১৫৭।
[4] আল ইসরা, ১৭ : ৩২
[5] আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর প্রকাশ্য বা গোপন কোনো অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না।” [সূরা আনআম, ৬ : ১৫১]