অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা না থাকলে, অটোমেটিক সেখানে গাইরুল্লাহর মহব্বত স্থান পায়। কারণ, ‘আমাদের দেহ অলস হয়ে পড়লেও অন্তর কখনো অলস হয় না। আমাদের নফস আমাদেরকে হয় ভালোর দিকে নতুবা খারাপ কাজে ব্যস্ত রাখে।’[1] শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘কারও অন্তরে যদি আল্লাহর প্রতি তীব্র ভালোবাসা না থাকে, তবে সে অন্তর স্বাভাবিকভাবেই অন্য কারও ভালোবাসা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাবে। আমাদের নফস কখনোই অলস থাকে না। আমরা যদি একে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যস্ত না রাখি, তবে তা আমাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতায় ব্যস্ত রাখবে।’[2]
অন্তরে আল্লাহর প্রতি তীব্র ভালোবাসা না থাকলে, সেখানে সৃষ্টির প্রতি গভীর অনুরাগ অনায়াসেই ঢুকে যায়। তেমনি আমাদের জল্পনা-কল্পনায় যদি মহান আল্লাহ না থাকেন, অটোমেটিক সেখানে অন্যকিছু চলে আসে। আমাদের চিন্তা-চেতনায় যদি আল্লাহর যিকির, তাঁর বড়ত্ব, নবিজির প্রতি ভালোবাসা না থাকে, তাহলে আজেবাজে চিন্তা ঠিকই সেই ফাঁকাস্থান গ্রাস করে নেয়। অন্তর কখনোই খালি থাকবে না। সেটা কিছু-না-কিছু দ্বারা ভরাট হবেই। কাজেই, অন্তরকে হালাল ভালোবাসায় ব্যস্ত রাখুন। তাহলে গাইরুল্লাহর প্রতি যে টান ছিল, সেটা এমনিতেই কেটে যাবে।
শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, ‘কারও অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা আর প্রেম একসাথে জায়গা নিতে পারে না।’[3] দেখবেন, অন্তরে হালাল ভালোবাসা ঠাঁই পেলে, হারাম প্রেম এমনিতেই দূরে চলে যাবে। অন্ধকার দূর করার জন্যে অতবেশি হম্বিতম্বি করার দরকার নেই। হাতে থাকা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে নিন। অটোমেটিক আঁধার দূরীভূত হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি ইসলাম সমর্থিত ভালোবাসায় নিজের হৃদয়কে রাঙিয়ে নিন, হারাম থেকে বেঁচে থাকা খুব ইজি হয়ে যাবে। হারাম ভালোবাসার অসংখ্য বিকল্প সমাধান রয়েছে, সেগুলোতে নিজেকে অভ্যস্ত করুন:
- আল্লাহ[4] ও তাঁর রাসূলকে[5] ভালোবাসতে হবে সবচেয়ে বেশি। এইক্ষেত্রে কোনো গড়িমসি চলবে না। ঈমানদার হতে চাইলে অবশ্যই এই দাবি পূরণ করতে হবে। কাজেই, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা দিয়ে অন্তরকে রাঙিয়ে নিন।
- পিতা-মাতাকে ভালোবাসাও ইসলামের দৃষ্টিতে খুব জরুরি। এটা আল্লাহ তাআলার আদেশ।[6] তাদের খেদমত করা, খোঁজখবর রাখা, সুঃখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া—সন্তানের ওপর ফরজ দায়িত্ব। কোনো সন্তান যদি তাদেরকে অবহেলা করে, তবে সে নির্ঘাত ধ্বংস হবে।[7]
- ভালোবাসার আরেকটি ক্ষেত্র হলো আপন স্ত্রী। ভালোবসে স্ত্রীর মুখে কেউ যদি খাবার তুলে দেয়, তবে সেটার জন্যেও বদলা পাবে।[8] এমনকি স্ত্রীর সাথে সহবাস করলেও তার নেকি হবে। এই কথা শুনে সাহাবিরা বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজের স্ত্রী-সম্ভোগ করলেও সওয়াব হবে!’ আল্লাহর নবি ﷺ সরাসরি উত্তর না দিয়ে উপমা সহকারে বললেন, ‘আচ্ছা, বলো তো দেখি—যদি কেউ হারাম পথে নিজের চাহিদা মেটায় বা যিনা করে, তাহলে কি সে গোনাহের ভাগীদার হবে না? সুতরাং এই কাজ যখন সে বৈধভাবে করবে, এর জন্যে অবশ্যই সওয়াব পাবে।’[9] সুবহানাল্লাহ! কত বিস্ময়কর এক হাদিস! কত চমৎকার এক হাদিস! কোনো বান্দা তার শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্যে স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করলেও সওয়াব পাবে। এই ইবাদত কতই-না সহজ আমাদের জন্যে।
- নিজের সন্তান-সন্ততিকে ভালোবাসুন। সন্তানের জন্যে ভালোবাসা প্রকাশের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফজিলত। তাদের প্রতি স্নেহপরায়ণ হলে আল্লাহও আপনার প্রতি দয়া করবেন।[10]
- বড়-ছোটদের প্রতি খেয়াল রাখুন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘যারা বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’[11]
- দ্বীনি ভাইদেরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসুন। এটা বিশাল সওয়াবের কাজ। মুআয ইবনু জাবাল বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি—“আল্লাহ তাআলা বলেন: আমার মর্যাদা ও পরাক্রমশীলতার কারণে যারা পরস্পরকে ভালোবাসবে, (কিয়ামতের দিন) তাদের জন্যে থাকবে নূরের মিম্বার। নবি ও শহীদগণ পর্যন্ত তাদের দেখে ঈর্ষা করবেন।”[12] সুবহানাল্লাহ! ভালোবাসার কী মহা প্রদিতান! অপর ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা লালন করার কারণে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে নূরের মিম্বারে বসাবেন। শুধু তাই না, আরশের ছায়ার নিচেও আশ্রয় দেবেন।[13] নবিগণ-শহীদগণ আপনাকে দেখে ঈর্ষা করতে থাকবেন। তাহলে আর দেরি কেন?
এত এত ফজিলপূর্ণ ভালোবাসার জায়গা থাকতে, কেন শয়তানি ভালোবাসায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখবেন?
[1] ইবনুল কাইয়্যিম, তারিকুল হিজরাতাইন, পৃ. ৪১৩।
[2] Muhammad Salih Al-Munajjid, Lust, p. 24-25.
[3] Ibid, p. 15.
[4] সূরা তাওবা, ৯ : ২৪।
[5] নবি ﷺ বলেন, “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই।” [বুখারি, ১৫]
[6] সূরা বনি ইসরাইল, ১৭ : ২৩।
[7] হাদিসে বলা হয়েছে : যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতার দুজনকে অথবা একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, কিন্তু তাদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারল না, সে ধ্বংস হোক। [মুসলিম, ২৫৫১]
[8] নবি ﷺ বলেন, “আর যাই তুমি খরচ করবে, তা-ই তোমার জন্য সদাকা হবে। এমনকি যে লোকমাটি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে, তাও (সদাকা)।” [বুখারি, ৫৩৫৪]
[9][মুসলিম, ১০০৬]
[10] বুখারি, আল-আদাবুল মুফরাদ, ৮৮।
[11] তিরমিজি, ১৯২১।
[12] তিরমিয, ২৩৯০।
[13] বুখারি, ৬৬০; মুসলিম, ১০৩১; নাসায়ী, ৫৩৮০।